রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কৃষক তার পাকা ধানে আগুন দিল কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
দেশ স্বাধীন হওয়াতে কৃষকের যে ভাগ্য খুলেছে তা মোটেই নয়। হ্যাঁ, ধনী কৃষকের সুবিধা হয়েছে, তারা নিঃস্ব হয়ে-যাওয়া গরিব কৃষকের জমি অল্প দামে কিনে নিয়েছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে কৃষিতে, যন্ত্রপাতি কিনেছে এবং সেগুলো ভাড়াও দিতে পেরেছে মধ্য ও গরিব কৃষকের কাছে। টিকতে না-পেরে গরিব কৃষক তার জমি বেচে দিয়েছে। বেচে দিয়ে ক্ষেতমজুর হয়েছে। হয়তো নিয়োগ পেয়েছে তার নিজের জমিতেই, নতুন মালিকের অধীনে। নয়তো চলে গেছে শহরে। চালক হয়েছে রিকশার। কিশোরী মেয়েটিকে পাঠিয়েছে সে গার্মেন্টসে। গ্রামে থাকতে গরিব কৃষকের বুক কাঁপত কবে না জানি মেয়েটি অপহৃত হয়, ভাবত বিয়ে দিতে পারলে বাঁচবে। নাকি আত্মহত্যাই করল সে বেচারা? না, এখনো করেনি, তবে আগামীতে যে করবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ বাংলাদেশ তো উন্নতি করছে, শোনা যাচ্ছে উন্নতির গতিতে অচিরেই সে ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে, আর উন্নতি তো হবে ভারতের ওই পুঁজিবাদী ধারাতেই, যার বোঝা বহন করতে ব্যর্থ হয়ে সেখানে অনেক কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে।

আত্মহত্যা না করুক ধানের ভালো ফলন হলে গরিব কৃষকের যে সর্বনাশ ঘটে সেটা তো উন্মোচিত সত্য। চরম উন্মোচন ঘটেছে এ বছর। প্রচুর ফলন এবং সঙ্গে সঙ্গে দরপতন। হিসাব বলছে মুনাফা তো দূরের কথা, খরচও উঠছে না, মণপ্রতি আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা লোকসান হচ্ছে। যত বিক্রি তত লোকসান। ধান নিয়ে কৃষক এখন কী করে? অঝোরে কাঁদবে? কাঁদছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ কেউ যা করেছে তেমনটা এ দেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। কৃষক তার পাকা ধানে আগুন দিয়েছে। একশ বছর আগে শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের গফুর যেভাবে এবং যে কারণে তার প্রিয় ষাঁড়টিকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল এ ঘটনাও ঠিক সেই রকমেরই। এর আগে আমরা টমেটো, আনারস, দুধ, আলু, ডিম ইত্যাদি কৃষিপণ্য সড়কে এনে ফেলার ঘটনার কথা শুনেছি, কিন্তু প্রাণপ্রিয় ধানকে, সোনার বাংলার আসল সোনাকে নিজের হাতে পুড়িয়ে ছারখার করার কথা শুনিনি।

সরকার বলছে দামের ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। এটা বাজারের ব্যাপার। এবং বাজার মুক্ত, সেখানে চাহিদা ও সরবরাহের ঘাত-প্রতিঘাত। তা বুঝলাম এবং বাজার যে কী জিনিস তা আমরা জানিও। সবচেয়ে বেশি জানে শেয়ার বাজারে যারা টাকা খাটায় তারা। ওই বাজারে দাম যখন ওঠে তখনই বোঝা যায় সে পড়বে, যত উপরে ওঠা তত ভয়াবহ পতন। যা করার ম্যানিপুলেটররাই করে। সরকার দেখে। সরকারের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আছে, তারা ঠুঁটো জগন্নাথ। নাকি তারও অধম, কারণ ম্যানিপুলেশনে তারাও অংশীদার। সাবেক এক অর্থমন্ত্রী যিনি অবিস্মরণীয় সব উক্তি করে খুব বিখ্যাত হয়েছেন, তিনি বলতেন শেয়ার মার্কেটে জুয়াড়িরা যায়। তা যায় বটে। কিন্তু যারা জুয়াড়ি নয় তারাও যায়। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীরা যায়, বিনিয়োগের জায়গা পায় না বলেই যায়। এবং গিয়ে প্রায়শ সর্বস্বান্ত হয়। তা ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের পক্ষে শেয়ার বাজারে যাওয়াটা হয়তো বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু কৃষকের কী ধানের বাজারে না গিয়ে কোনো উপায় আছে? বেচবেটা কোথায়? আর ধানের ওই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কারা? করছে মিলমালিকরা। তাদের দালালেরা আছে, ওই দামে দালালেরা ধান কিনে নেয়। কৃষক তো অসহায়।

সরকার ইচ্ছা করলেই হস্তক্ষেপ করতে পারে। বলতে পারে সরকার নির্ধারিত দরেই কিনতে হবে। সরকারের অতিশক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন ও র‌্যাব এত কিছু পারে আর এটুকু পারে না? পারে; তবে করে না। করে না এ জন্য যে, যাকে সিন্ডিকেট বলা হয় মালিকদের সেই সিন্ডিকেট সরকারের ভেতরেই বসে আছে। মিলমালিকদের স্বার্থ এবং সরকারের স্বার্থ অনেক ব্যাপারেই এক ও অভিন্ন বটে। ধানের দাম ঠিক করার ব্যাপারেও।

স্মরণীয় যে, কৃষি কিন্তু ইতিমধ্যেই শিল্পে পরিণত হয়ে গেছে। সেখানে পুঁজি ও প্রযুক্তি খাটছে। লাঙল ও গরুতে আর কুলায় না। ধান যে ঢেঁকিতে পা দিয়ে ঘরের বউ-ঝিয়েরা ভানবে সে উপায় নেই। খোরাকির ধান অন্য কথা, অন্য ধান বিক্রি হয় বাজারে। গরিব কৃষক অতি দ্রুতগতিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কেননা ঘরে তার নগদ টাকা নেই, বউ-ঝি’র শাড়ি কাপড় থেকে শুরু করে চিকিৎসার ব্যয়, ঋণ শোধের দায়, সবকিছুই অপেক্ষমাণ থাকে ধান বিক্রির জন্য। মিলের মালিকরা পুঁজিপতি। ধান তাদের জন্য কাঁচামাল। সেই কাঁচামাল থেকে নানা রকমের পণ্য বের হয়। খুদ-কুঁড়া-ভুসি কোনো কিছু ফেলনা নয়, সবকিছু থেকেই বাণিজ্য পণ্যের উৎপাদন ঘটে। কৃষিতে এখন জমিদার-জোতদার নেই, আছে পুঁজির মালিক। পুঁজিবাদ কোনো ফাঁক রাখছে না। কৃষকের সর্বনাশ ঘটিয়ে পৌষ মাস সম্ভব হচ্ছে মিলমালিক ও চাল-ব্যবসায়ীদের জন্য। মিলের মালিক এবং গরিব কৃষকের ভেতর আজ যে সম্পর্কটি প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই সম্পর্কটিই কিন্তু পুনরুৎপাদিত হচ্ছে সমাজের সর্বক্ষেত্রে। আমাদের মনোজগতেও ওই সম্পর্কের স্থায়ী অধিষ্ঠান। নানা রূপে, রঙ ও ভঙ্গিতে।

কৃষকের গুরুত্ব কেবল সংখ্যা দিয়ে নিরূপণ করা যাবে না, যদিও সংখ্যায় তারা অনেক, তারাই সর্বাধিক; মানতে হবে এই সত্য যে, কৃষক না থাকলে কৃষিও নেই এবং কৃষি না থাকলে বাংলাদেশও নেই। সোনার বাংলা আর সোনার বাংলা থাকবে না, দোজখ হয়ে যাবে। সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে কৃষককে ভর্তুকি দেওয়া। বহুক্ষেত্রেই ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিভিন্ন শিল্প খাতে হরদম ভর্তুকি চাচ্ছে ও পাচ্ছে। পোশাক কারখানার মালিকেরা ভর্তুকি চেয়েছে। সেটা হয়তো পাবেও। কারণ যারা চাইছে দেবার মালিকও তারাই। রাখে হরি মারে কে। ওসব চাওয়া-পাওয়া চলবে। গত দশ বছরে ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফ হয়েছে দশ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছরে পুনঃতফসিল করা হয়েছে নব্বই হাজার কোটি টাকা। এসব চলছে। চলুক। তবে সবচেয়ে জরুরি যে খাত, কৃষি খাত, সেখানে অবশ্যই ভর্তুকি দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। ভর্তুকি দিয়ে ডিজেল, সেচ, সার, বীজ, কীটনাশক, ধান কাটা, মাড়াই, এক কথায় উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যাতে দরিদ্র কৃষকের কাছে স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য হয় সেটা দেখা চাই। উৎপাদন খরচ কমানো চাই। সরকারের দ্বিতীয় কর্তব্য বেশি করে ও সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা। সরকার ধান কেনা ক্রমাগত কমিয়ে এনেছে, করা দরকার কিন্তু ঠিক উল্টোটা। সরকার কিনেছে উৎপাদনের শতকরা মাত্র এক ভাগ। এই ক্রয়ের মধ্যে শুধু ধান নয়, চালও ছিল। ধানই কেনা দরকার, চাল নয়। সরকার চাল কেনে মিলমালিকদের কাছ থেকে, তাতে কৃষকের কোনো সুবিধা হয় না, সবটা সুবিধাই মিলমালিকদের। জানা গেছে যে, মিলমালিকরা যে শুধু নিজেদের মিলের জন্য ধান কেনে তা নয়, সস্তায় ধান কিনে সরকারের কাছে সরকার-নির্ধারিত দরে বিক্রিও করে। ধান কেনাতে লাভ, ধান বেচাতে লাভ, আবার ধান থেকে চাল ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করেও লাভ। ত্রিফলা। ওই যে গান আছে ‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’ এ সত্যের এ বড় সঠিক প্রমাণ।

সাবেক কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে রাজনৈতিক বাধা রয়েছে। এটা হচ্ছে সার কথা, লাখ কথার এক কথা। রাজনৈতিক বাধা মানে দলীয় বাধা, আর দল মানেই সরকারি দল। ধান কিনতে হয় মধ্যবর্তী ফড়িয়া-দালালদের মারফত, যাদের ভেতর সবাই হচ্ছে সরকারি দলের নেতা কিংবা কর্মী। কোনো কিছু না করে, মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়ে এরা কৃষকের প্রাপ্য দু’হাতে হাতিয়ে নিচ্ছে। কৃষকের হায় হায়টা বাড়ছে। ওদিকে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী, বলেছিলেন অন্য কথা। সেটি চমৎকার। তিনি বলেছিলেন, আমরা অর্থাৎ সরকারের লোকেরা পাশে না থাকলে উৎপাদন এত বাড়ল কী করে? তাই তো। বাড়ল কী করে? মন্ত্রী মহোদয় নিজেকে নিশ্চয়ই জনপ্রতিনিধি মনে করেন, কিন্তু তিনি অনেক কিছুই জানেন তবে এটুকু জানেন না যে, কৃষক দলীয় মাস্তানই হোক কী সরকারি আমলা কিংবা সরকারের বিবিধ বাহিনীর লোকজনই হোক, তারা পাশে থাকলে তো কথাই নেই, কাছে এগিয়ে আসছে দেখলেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। সরকারি লোকেরা মূলত যা উৎপাদন করে তা ভীতি; অন্য জিনিস উৎপাদনে তারা মোটেই দক্ষ নয়, বিশ্বাসীও নয়। ভীতির মধ্যেই এবং ভীতি সত্ত্বেও উৎপাদন ভালো হয়েছে। বড় কথা চাষিরা শ্রমে কোনো কসুর করেনি।

বলা হচ্ছে সরকারি গুদাম পর্যাপ্ত নয়। পর্যাপ্ত না হলে পর্যাপ্ত করা দরকার ছিল। পর্যাপ্ত করতে হবে। অনুৎপাদক খাতে ব্যয় করার সময়ে তো সরকারের অর্থ ও উদ্যোগ কোনোটারই সামান্যতম অভাব দেখা যায় না; তাহলে অত্যাবশ্যকীয় এই দায়িত্বপালনে অনীহা কেন? এমনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যাতে ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি চলে যাবে সরকারি গুদামে এবং মিলমালিকরা ধান কিনবে সেখান থেকেই, আর কিনবে সরকারি দরে। ধান দ্রুত আসবে সরকারি গুদামে এবং সেখান থেকে দ্রুত চলে যাবে ধানের কলে। বাইরের কায়কারবার সব বন্ধ।

বলা হচ্ছে, চাল রপ্তানি করা হবে। পাশাপাশি আমদানিও কিন্তু চলছে। এবং এমন সরকারি বক্তব্য শোনা গিয়েছিল যে, আমদানি চালু থাকবে। একই সরকারের এমন দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান বর্তমান বিশ্বে বিরল হতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশে তা মোটেই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বিশ্ব-দৃষ্টান্ত বৈকি। এক হাতে চাল বিদেশে পাঠানো, অন্য হাতে বিদেশ থেকে চাল আনা, এ নিয়ে খবরের কাগজে যে কোনো কার্টুন ছাপা হয়েছে তাও দেখিনি। কার্টুনে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে কি?

এক হাতে রপ্তানি অন্য হাতে আমদানি ওই দ্বৈতনীতির পরস্পর-বিরোধিতাটা কিন্তু আপাত মাত্র। ভেতরের বস্তু অভিন্ন, সেটা হলো মুনাফা। রপ্তানিতেও মুনাফা, আমদানিতেও মুনাফা। কেবল যে বাণিজ্যিক মুনাফা তা নয়; কারসাজি করে, কাগজে কলমে এক ক্ষেত্রে দাম কম অন্য ক্ষেত্রে দাম বেশি দেখিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা চলে। টাকা পাচারের এ এক ভালো রাস্তা। আবার আমদানি-রপ্তানির ক্রীড়াকৌতুকে বাণিজ্যিকভাবে যে মুনাফাটা আসছে সেটাও যে দেশে থাকবে, শিল্পকারখানা গড়তে খরচ হবে এটাও নিতান্তই দুরাশা। মুনাফার একটা বড় অংশের নিশ্চিত গন্তব্য ওই বিদেশই। পুঁজিবাদী দুনিয়ার এটি আরেক বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে শুনছি ধনীদের ধনবান হবার গতি চীনের ধনীদের গতিকেও হার মানিয়েছে এবং এই মহামান্য ধনীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিদেশে চলে গেছেন, অন্যরা যাওয়ার এন্তেজাম করছেন। ওই যে রক্ত-চোষা মুনাফা, ওটিই সার বস্তু। প্রত্যক্ষে অপ্রত্যক্ষে সব সরকারি নীতিরই মূল কথাটা এখন মুনাফা। আর সে-মুনাফা জনপ্রিয়তার নয়, অর্থবিত্তের বটে। সমষ্টিগত নয়, ব্যক্তিগত।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION